চাঁদপুর জেলায় নবযোগদানকৃত জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. কামরুল হাসানের সাথে চাঁদপুর প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের পরিচিতি সভা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল ২ জুন বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভার শুরুতেই পরিচিতি পর্বে উপস্থিত সাংবাদিকগণ প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ পরিচয় দেন। সভা সঞ্চালনায় ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইমতিয়াজ হোসেন।
জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান প্রথমেই উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছ থেকে বক্তব্য শুনতে চান। এ পর্বে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি গিয়াস উদ্দিন মিলনের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন দৈনিক চাঁদপুর খবর পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক সোহেল রুশদী। তিনি বক্তব্যে বড় স্টেশন মোলহেড পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়ন করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পর্যায়ক্রমে জেলার সমস্যা, উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিকবৃন্দ। সাংবাদিক পার্থনাথ চক্রবর্তী বলেন, চাঁদপুরে প্রায় অর্ধলাখ জেলে ইলিশ মাছ আহরণের সাথে জড়িত। মাছ আহরণ থেকে বিরত থাকাকালীন সময়ে তাদের খাদ্য সহায়তা না দিয়ে মোবাইলে নগদ অর্থ দেয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন করার দাবি জানান। দৈনিক শপথের সম্পাদক কাদের পলাশ বক্তব্যে বলেন, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও এখন পর্যন্ত অবকাঠামো হয়নি। এই বিষয়ে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দৈনিক চাঁদপুর কন্ঠের বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্যাহ বলেন, আধুনিক নৌ বন্দর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের কাজ এগিয়ে নিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি সাংবাদিক ও প্রশাসনের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন। কোনো সমস্যা হলে যেনো আলোচনার মাধ্যমে সেটি সমাধান হয়।
দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের বার্তা সম্পাদক আল-ইমরান শোভন পেশাগত কাজে জেলা প্রশাসককে তথ্য দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। দৈনিক প্রভাতী কাগজের সম্পাদক আব্দুল আউয়াল রুবেল বক্তব্যে ইলিশের প্রাচুর্যতা ফিরিয়ে আনতে বাস্তব প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সাথে তিনি সাংবাদিকদেরকে তথ্য দেয়ার জন্য একটি মেসেঞ্জার গ্রæপ করার দাবি জানান।
দৈনিক চাঁদপুর সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, বিগত দিনে যেসব জেলা প্রশাসকগণ ছিলেন, তাদের কাজগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নবাগত জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেন। একই সাথে তিনি চাঁদপর শহরকে পর্যটনের শহর পরিণত করার কথা বলেন।
মেঘনা বার্তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জিএম শাহীন বলেন, চাঁদপুরে একটি শিশু পার্ক চাই। এখানে পার্ক নেই, সিনেমা হল নেই এবং হাঁটার কোনো ভালো জায়গা নেই। এসব বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
দৈনিক চাঁদপুর প্রতিদিনে সম্পাদক ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী বলেন, মূলতঃ চাঁদপুর শহর ভাসমান। যে কোন সময় তলিয়ে যেতে পারে। এটি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্থানীয় সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী সার্বিক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এটির জন্য ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প করা হয়েছিলো। যানজট নিরসন এবং চাঁদপুর সেতুর টোল আদায় বন্ধের বিষয়টি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
দৈনিক মানব কণ্ঠের জেলা প্রতিনিদি শাহাদাত হোসেন শান্ত বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একটানা প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতায়। সারাদেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। চাঁদপুরও সেই উন্নয়নের অংশীদার। তারপরেও গণমানুষের দীর্ঘ নিঃশ^াস আছে।
এনটিভির জেলা প্রতিনিধি শরীফুল ইসলাম বলেন, জেলেদের নিয়ে আমাদের বেশি রিপোর্ট তৈরি করতে হয়। জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় যে অভিযান হয়। জেলেরা তখন যে সহায়তা পায়, তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না।
দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার শাওন পাটওয়ারী বলেন, উৎসবকালীন সময়ে বড় স্টেশন মোলহেড খুবই ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। অনেক মানুষের সমাগম ঘটে। এক্ষেত্রে শহরের পুরাণবাজারও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেখানে মেঘনা নদীর পাড়ে রনাগোয়াল থেকে দক্ষিণে বিশাল জায়গা আছে। উদ্যোগ নিয়ে ওই এলাকা পর্যটনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
এশিয়ান টিভির জেলা প্রতিনিধি খুরিশদ আলম বলেন, চাঁদপুর জেলার সাথে বরিশাল ও শরীয়তপুর জেলার সীমানা বিরোধ আছে। সেখানে এখনো একটি চক্র চাঁদপুরের লোকজনের সাথে জুলুম করছে। তাদের কাছ থেকে বার্ষিক খাজনা আদায় করে। সীমানা বিরোধ মিমাংসা করার জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একই সাথে হাইমচরের অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ থেমে থাকার বিষয়টি অবহিত করেন।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর জেলা প্রতিনিধি আব্দুল সালাম আজাদ জুয়েল বলেন, সরকারি বিভিন্ন ভাতা বন্টন সঠিকভাবে হয় না। এসব ভাতা পাওয়ার জন্য লোকজন অর্থ খরচ করতে হয়। এমন তথ্য তার নিকট আছে। ৪০ দিনের কর্মসূচিতে অনিয়ম হয়। শ্রমিকদের টাকা সঠিকভাবে পায় না। তাদের মোবাইল সিমগুলো জনপ্রতিনিধিদের কবজায়।
ডিবিসি নিউজের জেলা প্রতিনিধি তালহা জুবায়ের চাঁদপুর স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য অনুরোধ করেন। একই সাথে খেলার মাঠ নেই উল্লেখ করে হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটি হকারদের দখল থেকে মুক্ত করার কথা বলেন। তালহা বলেন, চাঁদপুরের লেকগুলো ময়লা ফেলে দখলের চেষ্টা চলছে। এগুলো উদ্ধার করতে হবে।
দেশ টিভির জেলা প্রতিনিধি ল²ণ চন্দ্র সূত্র ধর বলেন, পকেটে হাত দিলেই ভিক্ষুক এসে দাঁড়ায়। ভিক্ষুকমুক্ত কর্মসূচি জোরদার করার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি এমএ লতিফ বলেন, সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানে প্রতি সপ্তাহে গণশুনানী করতেন, এটি অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান।
সাংবাদিক অভিজিত রায় সাংস্কৃতিক চর্চায় শিল্পকলা একাডেমির সংস্কার ও টাউন হল নির্মাণের দাবি জানান। সাংবাদিক সেলিম রেজা যানজট নিরসনে বাইপাস সড়ক নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করেন। প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধি আলম পলাশ বলেন, নবাগত জেলা প্রশাসকের সাথে আমাদের কাজের মাধ্যমে কথা হবে। তখনই বিভিন্ন বিষয়গুলো উঠে আসবে।
দৈনিক চাঁদপুর বার্তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শহীদ পাটোয়ারী অভিজিৎ রায়ের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, শিল্পকলা একাডেমির নির্বাচিত কমিটি চাই। তিনি সাংকৃতিক অঙ্গনের লোকদের সাথে জেলা প্রশাসকের বসার জন্য অনুরোধ জানান।
দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রহিম বাদশা বলেন, আমরা যেহেতু সাংবাদিক। আমাদের পেশাগত বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিব। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেন একটি মেসেঞ্জার গ্রæপ করা হয় এবং দ্রæত সময়ের মধ্যে। এর মাধ্যমে আমরা প্রশাসনের কাজের তথ্যগুলো সঠিকভাবে পাব এবং স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করা সহজ হবে। অনেক সময় জেলায় মন্ত্রী আসলেও আমরা জানি না। তথ্যগুলো মেসেঞ্জারে দিয়ে দেয়া হলে খুব কম সময়ে সবার কাছে পৌঁছবে।
দৈনিক চাঁদপুর কন্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত বলেন, আমার বক্তব্যের পূর্বে সহকর্মীদের বক্তব্যে জেলার নানা সমস্যার কথা এসেছে। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে অনেক জেলা প্রশাসকের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে জেলা ব্র্যান্ডিং নিয়ে জেলা প্রশাসক আব্দুর সবুর মন্ডলের সাথে কাজ করেছেন। পর্যটন সম্পর্কে তিনি বলেন, মোলহেডের উত্তরে একটি নতুন চর জেগে উঠেছে। সেখানে পর্যটন কেন্দ্রে করার জন্য জাপানের একটি কোম্পানী কাজ করছেন।
চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ ফেরদৌস বলেন, আমাদের সহকর্মীদের বক্তব্যে বেশীরভাগ সমস্যার কথা উঠে এসেছে। আমি মনে করি সমস্যার পাশাপশি চাঁদপুরে অনেক সম্ভাবনাও আছে। সেই সম্ভাবনাগুলো নিয়ে নবাগত জেলা প্রশাসক কাজ করবেন। সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সাংবাদিকদেরকে তিনি প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান।
চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতি গিয়াস উদ্দিন মিলন বলেন, জেলায় অনেকগুলো বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। আধুনিক নৌ বন্দর, মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। এসব উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন নবাগত জেলা প্রশাসক। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়। এটির স্থান কোথায় নির্ধারণ হবে সেটি আমাদের জানার বিষয় নয়। আমরা চাই বিশ^বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হউক। তিনি বলেন, চাঁদপুর স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। এই টাকা এনে কাজ বাস্তবায়ন করা দরকার। এছাড়াও যানজট নিরসনে বাইপাস সড়কের বিষয়টি তিনি বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
সবশেষে বক্তব্য রাখেন নব যোগদানকৃত জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান। তিনি বলেন, আমি আপনাদের ২৫ জনের বক্তব্য শুনেছি। আপনাদের বক্তব্যের মাধ্যমে অনেক তথ্য পেয়েছি এবং তথ্যগুলো গ্রহণ করলাম। আমি ৬ মাস বসে থেকেও এই ধরণের তথ্য পেতাম না। আপনাদের তথ্যগুলো নিয়েই আমি কর্মপরিকল্পনা সাজাব। আপনাদের সাথে শুরুতেই বসার বিষয়টি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। আমি চাই প্রতি ৩ মাস পর পর আপনাদের সাথে বসলে সব বিষয়ে জানতে অনেক সহজ হবে।
তিনি বলেন, আপনাদের সব লেখা আমি ইতিবাচক ভাবে নিব। কতদিন এই জেলায় থাকব সেটা আমিও জানি না। তবে আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে আমি যাব। আমি কোনো দাগ নিয়ে যেতে চাই না। আপনাদের সাথে নিয়ে কাজ করবো। আপনাদের কথার আলোকে ম্যাসেঞ্জার গ্রæপ করা হবে। খুব শীগগীরই এটি বাস্তবায়ন হবে। সেখানে তথ্য দেয়া হবে, যেসব তথ্য প্রকাশযোগ্য। জেলা প্রশাসক বলেন, কোনো ব্যাক্তি ভুল করতে পারে। তবে তাকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দিবেন। তারপরও সংশোধন না হলে লিখবেন। লেখার বিষয়ে আপনারা উন্মুক্ত। আপনাদের লেখায় শিকল লাগাতে চাই না। আপনাদের সকলের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করব।